🔹 ভূমিকা
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বিতরণের জন্য একটি কার্যকর গ্রীড সিস্টেম অপরিহার্য। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা দ্রুত উন্নত হচ্ছে, তবে গ্রীড সিস্টেম নিয়ে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা জানব—
✔ গ্রীড সিস্টেম কী?
✔ এর বিভিন্ন প্রকারভেদ ও প্রয়োজনীয়তা
✔ বাংলাদেশের গ্রীড সিস্টেমের বর্তমান অবস্থা
✔ চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সম্ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত।

🔹 গ্রীড সিস্টেম কী?
গ্রীড সিস্টেম হলো এমন একটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি মূলত তিনটি প্রধান উপাদান নিয়ে গঠিত:
- উৎপাদন (Generation): বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী স্টেশন বা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এটি যেমন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বা সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে পারে।
- পরিবহন বা সঞ্চালন (Transmission): উৎপাদিত বিদ্যুৎ উচ্চ ভোল্টেজের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। উচ্চ ভোল্টেজে বিদ্যুৎ পরিবহন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ হ্রাস পায় না। এটি সাধারণত ট্রান্সমিশন লাইন দ্বারা সঞ্চালিত হয়, যা খুব বড় দূরত্ব পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছায়।
- বিতরণ (Distribution): ট্রান্সমিশন সিস্টেমের মাধ্যমে পৌঁছানো উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ কেবলমাত্র স্থানীয় ট্রান্সফরমার ব্যবহার করে বন্টন করা হয়, এবং তা ব্যবহারকারীদের জন্য উপযুক্ত ভোল্টেজে পরিণত হয়।
এই সিস্টেমটি স্থিতিশীল এবং কার্যকরভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একযোগে কাজ করে। কোনো এক অংশে সমস্যা হলে পুরো সিস্টেমে প্রভাব পড়তে পারে, তাই এর স্থিতিশীলতা এবং নির্ভরযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Table of Contents
🔹 গ্রীড সিস্টেমের প্রকারভেদ
গ্রীড সিস্টেম প্রধানত তিন প্রকার, যেমনঃ-
১. রেডিয়াল গ্রিড সিস্টেমঃ– এই সিস্টেমে প্রত্যেকটি ফিডার গ্রিড সাবস্টেশন হতে বাহিরের দিকে ছড়িয়ে যায় এবং ডিস্ট্রিবিউটর ও সার্ভিস মেইনগুলো সাবস্টেশন হতে বাইরের দিকে ছড়িয়ে যায় অর্থাৎ একটি মাত্র ফিডারের মাধ্যমে সাবস্টেশনগুলো এক দিক থেকে ফিড হয়। তবে এ ধরনের গ্রিড সিস্টেম খুবি সাধারণ এবং প্রাথমিক ব্যয় কম হওয়ায় কিছু সিমাবদ্ধতা ও পরিলক্ষিত হয়
২. রিং মেইন গ্রিড সিস্টেমঃ– এই সিস্টেমে দুটি ফিডার গ্রিড সাবস্টেশন হতে বাইরের দিকে ছড়িয়ে যায় এবং ডিস্ট্রিবিউটর ও সার্ভিস মেইনগুলো সাবস্টেশন হতে বাইরের দিকে ছড়িয়ে যায়। এখানে প্রতিটা সাবস্টেশন দুইটি করে ফিডারের মাধ্যমে সাপ্লাই পায়, এইজন্য এই সিস্টেমকে রিং মেইন গ্রিড সিস্টেম বলে।
৩.আন্তঃসংযোগ গ্রিড সিস্টেমঃ– গ্রিড সাপ্লাই সিস্টেম একটি আন্তঃসংযোগ নেটওয়ার্ক বিশেষ, যেখানে প্রতিটি ফিডার দুই বা ততোধিক জেনারেটিং স্টেশন বা সাবস্টেশনের মাধ্যমে পাওয়ার গ্রহণ করে থাকে।
এছাড়াও গ্রিড সিস্টেমকে আরো বেশ কিছু শ্রেনিভাগে ভাগ করা যায়, যথাঃ-
১. সরবারাহের ধরনের উপর ভিত্তি করে, গ্রিড দুই ধরনের যথাঃ-
- AC গ্রিড
- DC গ্রিড
২. লাইনের ধরনের উপর ভিত্তি করে, গ্রিড তিন ধরনের যথাঃ-
- সিংগেল লাইন গ্রিড সিস্টেম
- ডাবল লাইন গ্রিড সিস্টেম
- ত্রিপল লাইন গ্রিড সিস্টেম

নিচে আরো কিছু গ্রিড সিস্টেমের বর্ণনা দেওয়া হলোঃ-
১. ন্যাশনাল গ্রীড (National Grid)
ন্যাশনাল গ্রীড হলো দেশের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এবং জাতীয়ভাবে বিদ্যুৎ বিতরণ করে।
✅ বৈশিষ্ট্য:
- একাধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করে বিতরণ করা হয়।
- জাতীয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ সংকট এড়াতে সাহায্য করে।
- কোনো অঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি হলে অন্য অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়।
পল্লী বিদ্যুৎ মিটার পরিবর্তনের আবেদন করার নিয়ম : সম্পূর্ণ গাইড
২. স্মার্ট গ্রীড (Smart Grid)
স্মার্ট গ্রীড হলো আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর একটি গ্রীড ব্যবস্থা, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা করতে পারে এবং লোড ব্যালান্সিং করতে সক্ষম।
✅ বৈশিষ্ট্য:
- রিয়েল-টাইম বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা
- স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ
- বিদ্যুৎ চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও বিতরণ সমন্বয় করা
৩. মাইক্রোগ্রীড (Microgrid)
মাইক্রোগ্রীড হলো একটি ছোট আকারের গ্রীড ব্যবস্থা, যা নির্দিষ্ট এলাকা বা প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে।
✅ বৈশিষ্ট্য:
- বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়
- জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করে
- নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার উপযোগী
🔹 বাংলাদেশের গ্রীড সিস্টেমের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে গ্রীড সিস্টেমের গুরুত্ব অপরিসীম। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
- বিদ্যুৎ সরবরাহের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায়।
- শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা যায়।
- একাধিক ফিডিং পয়েন্ট সুবিধা পাওয়া যায়।
- পাওয়ার সিস্টেমের লোড ফ্যাক্টর ও ডাইভারসিটি ফ্যাক্টরের মান উন্নত করা যায়।
- লোডশেডিং হ্রাস করা যায়।
- গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবারাহ সব সময় চালু রাখা যায়।
- দূরবর্তী এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া যায়।
- বিদ্যুতের অপচয় রোধ করা যায়।
- সর্বোচ্চ মাত্রায় ইফিসিয়েন্সি পাওয়া যায়।
- জেনারেটিং স্টেশনগুলোকে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধা পাওয়া যায়।
- ভবিষ্যৎ বিস্তারে আগত লোড বহন ইত্যাদি।
গ্রিড সিস্টেমের কারনে পাওয়ার সিস্টেমের দক্ষতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায় এবং সমগ্র পাওয়ার সিস্টেমের বিশ্বস্ততা অনেকগুন বৃদ্ধি পায়।
🔹 বাংলাদেশের গ্রীড সিস্টেমের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই গ্রিড সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে ন্যাশনাল গ্রীডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, যা Power Grid Company of Bangladesh (PGCB) কর্তৃক পরিচালিত। বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিড ভোল্টেজ মূলত ২৩০ কেভি ও ১৩২ কেভি । ২৩০কেভি লাইনকে সুপার গ্রিড বলা হয়।
বাংলাদেশের সকল কেন্দ্র গ্রিড লাইনের মাধ্যমে আন্তঃসংযুক্ত। এবং দেশের ২৩০ কেভি গ্রিড লাইনের দৈর্ঘ্য ২৫০ কিলোমিটার এবং ১৩২ কেভি লাইনের দৈর্ঘ্য ২২০৭ কিলো মিটার এছাড়া রাজশাহী, ঈশ্বরদী, পাবনা, উওল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত লাইনটি ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এই লাইনটি ৬৬ কেভি ভোল্টেজে চলে।
✅ বিদ্যুৎ উৎপাদন: ২৫,০০০+ মেগাওয়াট (২০২৪)
✅ গ্রিড সংযোগ: ৯৮% অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ
✅ স্মার্ট গ্রীড প্রকল্প: বাস্তবায়নাধীন
🔹 গ্রীড সিস্টেমের প্রধান চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ গ্রীড সিস্টেম বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে:
❌ লোডশেডিং ও অতিরিক্ত চাহিদা
❌ সঞ্চালন লাইনের অপ্রতুলতা
❌ বৈদেশিক জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা
❌ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতি
❌ স্মার্ট গ্রীড প্রযুক্তির অভাব
🔹 গ্রীড সিস্টেমের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা
বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ গ্রীড সিস্টেম উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
✅ স্মার্ট গ্রীড চালু করা
✅ নতুন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন
✅ নবায়নযোগ্য জ্বালানির সংযোজন
✅ লোডশেডিং কমানোর জন্য ব্যাকআপ ব্যবস্থা
🔹উন্নত দেশের গ্রিড সিস্টেমের সামগ্রীক চিত্র
উন্ন দেশের গ্রিড সিস্টেমের আমাদের দেশের ন্যায় তিন ধরনের গ্রিড ব্যবস্থা চালু আছে, তবে গ্রিড ব্যবস্থায় সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং উন্নত ব্যবস্থা আবুধাবীতে বিদ্যমান । উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যুৎ গ্রীড সিস্টেম অত্যন্ত উন্নত, স্মার্ট এবং টেকসই। তারা কেবল নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহই নিশ্চিত করে না, বরং নবায়নযোগ্য শক্তির সংযোজন, ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং গ্রাহককেন্দ্রিক সেবা প্রদানেও অগ্রণী।

🔹 সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
১. গ্রীড সিস্টেম কী?
গ্রীড সিস্টেম হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর একটি সংযোগ ব্যবস্থা।
অর্থাৎ গ্রিড সিস্টেম মূলত একটি আন্তঃসংযোগ নেটওয়ার্ক বিশেষ, যেখানে প্রতিটি ফিডারের নূন্যতম দুই বা ততোধিক জেনারেটিং স্টেশনের মাধ্যমে পাওয়ার ফিড হয়।
২. বাংলাদেশে কোন ধরনের গ্রীড ব্যবহৃত হয়?
বাংলাদেশে মূলত ন্যাশনাল গ্রীড ব্যবহৃত হয়, তবে স্মার্ট গ্রীড ও মাইক্রোগ্রীড ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে।
৩. স্মার্ট গ্রীড কী?
স্মার্ট গ্রীড হলো এমন একটি আধুনিক গ্রীড ব্যবস্থা, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারের তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে।
৪. গ্রীড সিস্টেম উন্নত করার উপায় কী?
- নতুন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন
- স্মার্ট গ্রীড প্রযুক্তির ব্যবহার
- নবায়নযোগ্য শক্তির সংযোজন
🔹 উপসংহার
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ গ্রীড সিস্টেম উন্নতির পথে রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্মার্ট গ্রীড প্রযুক্তির ব্যবহার ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সংযোজন ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ সেক্টরকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করবে।
আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না! 💡⚡🚀
এতো সুন্দর বাবে কথা গুলো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন এ সমস্ত লাইনগুলোতে কারেন্ট কি সব সময় থাকে না লোকাল লাইন গুলোর মত কারেন্ট আসে যায়?
thank you.