সহজভাবে বললে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের স্থান পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছাতে বিভিন্ন কারণে বিদ্যুৎ এর যে সকল লস হয় তাকে সিস্টেম লস বলে। আজ আমরা বিদ্যুতের সিস্টেম লস কি ও কত প্রকার? কারণসহ নিচে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ আলোচনা করবো। আশা করি আজকের পর আর আপনাদের বিদ্যুতের সিস্টেম লস নিয়ে আর কোনো সমস্যা থাকবে না তাই নিচের পুরো আলোচনাটি মন দিয়ে পড়ুন এবং ভালো লাগলে অবশ্যই আপনার সোশাল মিডিয়াতে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
সূচিপত্র
সিস্টেম লসের সংজ্ঞা
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের স্থান বা গ্রাহক পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছাতে বিদ্যুৎ পরিবহন,উৎপাদন কেন্দ্রের নিজেস্ব ব্যবহারশ যন্ত্রপাতির অপচয়,কারিগরি ও অকারিগরি কারণে বিদ্যুৎ এর যে সকল লস বা অপচয় হয় তাকে বিদ্যুতের সিস্টেম লস বলে। সিস্টেম লসকে শতকরায় প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের বিতরণ লাইনের সিস্টেম লস ৭.২৫% , সঞ্চালন লাইনের সিস্টেম লস ৩.১৩% অর্থাৎ বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের মোট সিস্টেম লসের পরিমাণ ১০.০৬%।
সিস্টেম লসের সূত্র
শতকরা(%) সিস্টেম লস = (মোট উৎপাদিত বিদ্যুৎশক্তি – মোট ব্যবহৃত বিদ্যুৎ শক্তি x ১০০) / মোট উৎপাদিত বিদ্যুৎশক্তি।
অর্থাৎ মোট উৎপাদিত বিদ্যুৎ এর থেকে মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতকে বিয়োগ করে তাকে ১০০ দিয়ে গুন করে গুণফলকে মোট উৎপাদিত বিদ্যুৎ দ্বারা ভাগ করলে শতকরা কত (%) সিস্টেম লস হয়েছে তা পাওয়া যায়।
উদাহরণস্বরূপঃ মনে করি, মোট উৎপাদিত শক্তি = ১০০ মেগাওয়াট কিন্তু মোট ব্যবহৃত বিদ্যুৎ হচ্ছে ৮৫ মেগাওয়াট তাহলে এখানে মোট সিস্টেম লস কত?
সমাধানঃ মোট সিস্টেম লস (%) = (১০০ – ৮৫ x ১০০) / ১০০ = (১৫ x ১০০) / ১০০ = ১৫%
অর্থাৎ এখানে মোট উৎপাদিত বিদ্যুৎ থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহার পর্যন্ত পৌঁছাতে ১৫% বিদ্যুৎ বিভিন্ন কারনে লস বা অপচয় হয়েছে।
নিচে বাংলাদেশে গত ১২ বছরের বা বিগত ১২ অর্থ বছরের বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের সিস্টেম লসের একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হলোঃ
অর্থ-বছর | বিতরণ লস | সঞ্চালন লস | বিতরণ ও সঞ্চালন লস |
২০১২-১০১৩ | ১২.০৩% | ২.৯৪% | ১৪.৩৬% |
২০১৩-২০১৪ | ১১.৯৬% | ২.৭৪% | ১৪.১৩% |
২০১৪-২০১৫ | ১১.৩৬% | ২.৭৬% | ১৩.৫৫% |
২০১৫-২০১৬ | ১০.৯৬% | ২.৬৩% | ১৩.১০% |
২০১৬-২০১৭ | ৯.৯৮% | ২.৬৭% | ১২.১৯% |
২০১৭-২০১৮ | ৯.৬০% | ২.৭৫% | ১১.৮৭% |
২০১৮-২০১৯ | ৯.৩৫% | ৩.১০% | ১১.৯৬% |
২০১৯-২০২০ | ৮.৭৩% | ২.৯১% | ১১.২৩% |
২০২০-২০২১ | ৮.৪৮% | ৩.০৫% | ১১.১১% |
২০২১-২০২২ | ৭.৭৪% | ২.৮৯% | ১০.৪১% |
২০২২-২০২৩ | ৭.৬৫% | ৩.০৭% | ১০.৩৩% |
২০২৩-২০২৪ | ৭.২৫% | ৩.১৩% | ১০.০৬% |
সিস্টেম লসের প্রকারভেদ ও কারণ
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সিস্টেম লস দুই প্রকার যথাঃ-
- কারিগরি লস বা টেকনিক্যাল লস (Technical Loss)
- অকারিগরি লস বা নন টেকনিক্যাল লস (Non-Technical Loss)
কারিগরি লস (Technical Loss)
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় সিস্টেম লসের সাধারণ কারণকে কারিগরি লস বলা হয়। কারিগরি লসের মূল কারণ হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হতে লোড পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছাতে বিদ্যুৎ পরিবহন লাইনের রোধ (বাধা) বা রেজিস্ট্যান্স জনিত লস, বিদ্যুতের যন্ত্রপাতির লস বা ইকুইপমেন্ট জনিত লস, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিজস্ব ব্যবহার ।অর্থাৎ কারিগরি এই লসকে তিনভাগে বিশ্লেষণ করা যায়। নিচে তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ
১. বিদ্যুৎ পরিবহনজনিত লস ( Transmission Loss) :
সাধারণত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ প্রাপ্যতার ভিত্তিতে জনবহুল এলাকা ও যেখানে লোড ব্যবহার হবে তার থেকে দূরে স্থাপিত হয়ে থাকে। এবং এই সকল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দীর্ঘ ট্রান্সমিশন লাইনের মাধ্যমে বিতরণ কেন্দ্রে এবং পরে তা বিতরণ লাইনের মাধ্যমে গ্রাহকপ্রান্তে পৌঁছানো হয়। আমরা সকলেই জানি, বিদ্যুতের লাইনের লস হলো I2R ফলে যেহেতু বাংলাদেশে ৩ তার বা ৩ফেজ বিশিষ্ট ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লাইন ব্যবহার হয় তাই এখানে পরিবহন লাইনের ট্রান্সমিশন লস 3I2R যেখানে I = লাইনে প্রবাহিত কারেন্ট এবং R = প্রতি তারের বা ফেজের রেজিস্ট্যান্স, আর লাইন কারেন্ট, I = MW/√3Vcosθ
ট্রান্সমিশন ভোল্টেজ সাধারণত (KV) কেভি-তে প্রকাশ করা হয় এবং লাইন কারেন্ট কমানোর জন্য ট্রান্সমিশন ভোল্টেজের অত্যন্ত উচ্চমানের বৃদ্ধি করা হয়।যেহেতু লস ,লাইনে প্রবাহিত কারেন্টের বর্গের অনুপাতে বাড়ে সুতরাং লাইন কারেন্ট খুব কম হলে ও লসের পরিমাণ কম হয় না।
অর্থাৎ পরিবহন জনিত অপচয় বা লস দুইটি উপায়ে কমানো যায়।যথাঃ- ১. বিদ্যুৎ পরিবহন ভোল্টেজ বৃদ্ধি করে এবং ২. কম বাধা বা রেজিস্ট্যান্স সম্পন্ন পরিবাহী তার ব্যবহার করে।
২.যন্ত্রপাতি বা ইকুইপমেন্ট জনিত লস ( Machinery Loss ) :
বিদ্যুৎ পরিবহন ও বিতরণ কাজে ব্যবহৃত ট্রান্সফরমার,সুইচ গিয়ার ইত্যাদির নিজস্ব রেজিস্ট্যান্স জনিত লসকে যন্ত্রপাতি বা ইকুইপমেন্ট জনিত লস বলা হয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারে ট্রান্সফরমারের কোর লস ও কপার লস বৃদ্ধি ও সুইচ গিয়ারের ক্ষয় বা অপচ্যজনিত লস বৃদ্ধি পায়।যা সিস্টেম লসের উপর ব্যপক প্রভাব ফেলে । বাংলাদেশে সব বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় আনুমানিক এই লসের পরিমাণ ৪-৬% হয়।
৩.বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিজস্ব ব্যবহার (Own Use of Power Station) :
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফিড ওয়াটার পাম্প পরিচালনা, ডিসি ব্যাটারি চার্জ, নিরাপত্তামূলক বাতি বা লাইটিং, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ইত্যাদি পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। এছাড়াও বিদ্যুৎ কেন্দ্র যদি কোনো কারণে অচল হয়ে পড়ে বা নিয়মিত ওভার হলিং এর প্রয়োজনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র দীর্ঘদিন উৎপাদন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে, ওই সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন অংশ সচল রাখার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। এছাড়াও স্বাভাবিক চালু অবস্থায় অক্সিলারিজ এনরাইজড রাখার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যয় হয়।যার কোনো বিল হয় না।
আরো পড়ুনঃ বিদ্যুৎ কর্মীদের বৈদ্যুতিক দূর্ঘটনার : কারণ ও প্রতিকার
অকারিগরি লস বা নন টেকনিক্যাল লস (Non-Technical Loss)
বিদ্যুৎ সিস্টেমের লসের মধ্যে কারিগরি দিকই প্রধানত বিবেচনায় নেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিস্টেম লস অত্যাধিক হওয়ার মূল কারণ হলো অকারিগরি লস। অতএব কারিগরি লস ব্যতিরেকে বিদ্যুতের যে অপচয় বা লস হয় সেটাকেই বলা হয় অকারিগরি লস। অকারিগরি লস মূলত তিনটি কারণে ঘটে যথাঃ-
- কনজাম্পশন লস (Consumption loss)
- বিলিং লস(Billing Loss)
- কালেকশন লস(Collection Loss)
১.কনজাম্পশন লস
গ্রাহক কি পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করছে, সেটি গ্রাহকের মিটার হতে জানা যায়। কিন্তু মিটার খারাপ ব নষ্ট, মিটার টেম্পারিং, মিটার বাইপাস,হুকিং করে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার, মিটার বিহীন সংযোগ ইত্যাদির কারণে গ্রাহকের প্রকৃত বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ জানা যায় না। এর ফলে যে লস হয় তাকে কনজাম্পশন লস বলা হয়ে থাকে।
২. বিলিং লস
বৈদ্যুতিক মিটারের রিডিং হতে কম বিল করা অকারিগরি লসের আরেকটি অন্যতম কারন। অনেক সময় অসাধু গ্রাহক এবং অসৎ মিটার রিডার ও বিলিং সহকারী বা বিদ্যুৎ বিল প্রস্তুতকারী মিলে ইচ্ছাকৃতভাবে মিটারের রিডিং এর তুলনায় কম বিল করতে পারে। তবে এটা কিছু কিছু এই ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের কারণেও ঘটে। ফলে গ্রাহকের ব্যবহারের তুলনায় কম বিল হওয়ার কারণে সিস্টেম লস হয়। এই ধরনের লসকে বিলিং লস বলে।
৩.কালেকশন লস
বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া অনাদায়, ক্ষমতাবানদের চাপে বিল মাফ করে দেওয়া বা বিল কম করে দেওয়া , অসৎ উপায়ে মাফ করে নেওয়া ইত্যাদি কালেকশন লস হিসাবে বিবেচিত হয়।
এই অকারিগরি লস সংঘটিত হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসাবড়ি এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানে।এ অকারিগরি লস মূলত বিদ্যুৎ চুরি ।এ চুরির সঙ্গে বিদ্যুৎ সংস্থাসমূহের অসৎ কর্মী এবং কিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী জড়িত থাকে। এছা বস্তি এলাকা, শহর হতে দূরবর্তী প্রান্ত ইত্যাদি স্থানে হুকিং এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুরি থাকে।
নিচে বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বছর বা অর্থ বছর ভিত্তিক গত ৭ অর্থ বছরের পরিসংখ্যান দেওয়া হলোঃ
অর্থ বছর | BPDB | REB | DPDC | DESCO | WZPDCO | NESCO |
2016-17 | 10.92% | 11.38% | 8.48% | 7.24% | 9.57% | 11.06% |
2017-18 | 9.89% | 11.06% | 7.49% | 7.14% | 9.24% | 11.32% |
2018-19 | 9.12% | 10.87% | 7.37% | 7.11% | 8.83% | 10.52% |
2019-20 | 8.99% | 9.90% | 6.67% | 6.32% | 8.27% | 10.62% |
2020-21 | 8.50% | 9.67% | 6.77% | 5.58% | 7.88% | 10.49% |
2021-22 | 8.10% | 9.00% | 6.13% | 5.62% | 7.44% | 9.92% |
2022-23 | 7.92% | 8.56% | 5.71% | 5.72% | 7.33% | 9.51% |
বিদ্যুৎ সম্পর্কে বিস্তারিত আরো কিছু জানতে নিয়মিত ফলো করুন আমাদের Bidyutseva.com ওয়েবসাইট , ইউটিউব চ্যানেল
ELECTRICTY CRISIS এবং ফেসবুক পেইজ Electricity Crisis
3 thoughts on “বিদ্যুতের সিস্টেম লস কি ও কত প্রকার? কারণসহ ব্যাখ্যা”