সহজভাবে বললে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের স্থান পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছাতে বিভিন্ন কারণে বিদ্যুৎ এর যে সকল লস হয় তাকে বিদ্যুতের সিস্টেম লস বলে। আজ আমরা বিদ্যুতের সিস্টেম লস কি ও কত প্রকার? এবং কীভাবে বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমানো যায়? নিচে তা বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ আলোচনা করবো।
আশা করি আজকের পর আর আপনাদের বিদ্যুতের সিস্টেম লস নিয়ে আর কোনো সমস্যা থাকবে না তাই নিচের পুরো আলোচনাটি মন দিয়ে পড়ুন এবং ভালো লাগলে অবশ্যই আপনার সোশাল মিডিয়াতে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
সূচিপত্র
বিদ্যুতের সিস্টেম লস কি?
কিভাবে বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমানো যায় তা জানার আগে আমাদের প্রথমত জানতে হবে বিদ্যুতের সিস্টম লস মূলত কি? সিস্টম লস হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা ব্যবহার হওয়া পর্যন্ত বা গ্রাহক পর্যায়ে পৌছাতে বিদ্যুৎ একটা বিশাল তারের নেটয়ার্ক বা বিদ্যুৎ লাইন এবং অনেক যন্ত্রপাতি ও ইকুইপমেন্টের মধ্য দিয়ে যায় । এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌছানোর আগে মাঝ পথে সিস্টেমের বিদ্যুৎ লাইন এবং যন্ত্রপাতি ও ইকুইপমেন্টের বিভিন্ন বাধার ফলে কিছু পরিমাণ বিদ্যুৎ অপচয় বা লস হয়ে যায়। আর এই অপচয় বা লস হওয়া বিদ্যুতকেই বিদ্যুৎ এর সিস্টেম লস বলা হয় ।
বর্তমানে বাংলাদেশের ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের বিতরণ লাইনের সিস্টেম লস ৭.২৫% , সঞ্চালন লাইনের সিস্টেম লস ৩.১৩% অর্থাৎ বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের মোট সিস্টেম লসের পরিমাণ ১০.০৬%।
বিদ্যুতের সিস্টেম লস কত প্রকার ও কি কি?
সিস্টেম লস মূলত দুই প্রকার যথাঃ
১. কারিগরি লস বা টেকনিক্যাল লস (Technical Loss)
২. অকারিগরি লস বা নন-টেকনিক্যাল লস (Non-Technical Loss)
এই দুইপ্রকার সিস্টম লসকেই আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. কারিগরি লস বা টেকনিক্যাল লস (Technical Loss) তিন প্রকার যথাঃ-
- পরিবহনজনিত অপচয় (Transmission Loss)
- যন্ত্রপাতির অপচয় বা ইকুইপমেন্ট লস (Machinery Or Equipment Loss)
- বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিজস্ব ব্যবহার (Station Loss)
২. অকারিগরি লস বা নন-টেকনিক্যাল লস (Non-Technical Loss) তিন প্রকার যথাঃ-
- কনজাম্পশন লস (Consumption Loss)
- বিলিং লস (Billing Loss)
- কালেকশ লস (Collection Loss)
কীভাবে সিস্টেম লস কমানো যায়?
সিস্টেম লসের দুইটি কারণের মধ্যে বিদ্যুৎ সিস্টেমের লসের কারণ হিসাবে কারিগরি দিকই প্রধানত বিবেচনায় নেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিস্টেম লস অত্যাধিক হওয়ার মূল কারণ হলো অকারিগরি লস। নিচে সিস্টেম লস কমানোন উপায় গুলো দেওয়া হলোঃ
১.কারিগরি লস বা টেকনিক্যাল লস (Technical Loss) কমানোর উপায়ঃ
- লোড সেন্টারের কাছাকাছি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান করতে হবে।
- ছোট ছোট প্লান্টের মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে হবে।
- ট্রান্সমিশন লাইনকে সম্পূর্ণ আন্ডার গ্রাউন্ডের আওতায় নিয়ে আস্তে হবে।
- ট্রান্সমিশন লাইনের ভোল্টেজ বৃদ্ধি করতে হবে।
- ডিস্ট্রিবিউশন লাইনকে আধুনিকায়ন করতে হবে।
- পুরাতন ট্রান্সফরমার,ইকুইপমেন্ট ও সুইচ গিয়ার পরিবর্তন করতে হবে।
- ওভারলোডেড ট্রানফরমার পরিবর্তন করে সঠিকমানের ট্রান্সফরমার স্থাপন করতে হবে।
- শুধুমাত্র পিক আওয়ারে বা বিশেষ বিশেষ সময়ে গ্রিড ব্যবহার করতে হবে।
- বিতরণ সিস্টেমে পুরাতন ও ত্রুটিযুক্ত বিদ্যুতের মিটার পরিবর্তন ও পরিহার করতে হবে।
- এনালগ ও ডিজিটাল মিটার পরিবর্তন করে স্মার্ট ডিজিটাল এনার্জি মিটার বা স্মার্ট প্রিপেইড মিটার স্থাপন করতে হবে।
- ডিস্ট্রিবিশন লাইনে ফিডারের তিন ফেজের ব্যালেন্স সমতায় রাখতে হবে।
- লাইনের পাওয়ার ফ্যাক্টরের মান সর্বদা সর্বোচ্চ মানে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এজন্য সঠিকমানের ক্যাপাসিটর ব্যবহার করতে হবে।
- লাইনে কম রেজিস্টেন্সের কন্ডাক্টর ব্যবহার করতে হবে।
- লাইনের রাইট অফ ওয়ে সঠিক ভাবে থাকতে হবে।
- ওভারহেড ডিস্ট্রিবিউশন লাইনে ইন্সুলেটেড ক্যাবল ব্যবহার করতে হবে।
- নতুন লাইন নির্মানের ক্ষেত্রে লোড ক্যালকুলেশন বা স্ট্যাডি করতে হবে এবং লাইনের লংজিবিটি চিন্তা করতে হবে।
- দীর্ঘ ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন লাইন পরিহার করতে হবে।
- লাইনের ভোল্টেজ ড্রপ যেন না হয় সেদিকে সর্বদা নজরদারি করতে হবে এবং প্রয়োজনে সঠিকমানের ভোল্টেজ রেগুলেটর স্থাপন করতে হবে।
- দীর্ঘ ডিস্ট্রিবিউশন লাইন পরিহার করতে প্রয়োজন অনুযায়ী উপকেন্দ্র নির্মান করতে হবে।
- উৎপাদন কেন্দ্র,গ্রীড,উপকেন্দ্র ইত্যাদির নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং অপচয় রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ইত্যাদি।
উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চললে বিদ্যুতের কারিগরি সিস্টেম লস কমানো সম্ভব হবে বলে আশা করি।
আরো পড়ুনঃ বিদ্যুতের সিস্টেম লস কি ও কত প্রকার? কারণসহ ব্যাখ্যা
২. অকারিগরি লস বা নন-টেকনিক্যাল লস (Non-Technical Loss) কমানোর উপায়ঃ
বিদ্যুতের সিস্টেম লসের অকারিগরি অংশকে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বন্ধ করা যায়। উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে অকারিগরি লস কল্পনাও করা যায় না। বাংলাদেশে বিদ্যুতের সিস্টেম লসের অকারিগরি অংশকে যেসকল উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় নিচে তা দেওয়া হলোঃ
- অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে রাত্রকালীন অপারেশন বা মনিটরিং চালু করতে হবে
- বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে অথবা সেখানে মিটার সংযোগ করতে হবে।
- পুরাতন এনালগ ও ডিজিটাল মিটার পরিবর্তন করে আধুনিক স্মার্ট ডিজিটাল এনার্জি মিটার বা আধুনিক স্মার্ট স্মার্ট প্রিপেইড মিটার স্থাপন করতে হবে।
- মিটারে যথাযথ উপায়ে নিরাপত্তা সীল ব্যবহার করতে হবে এবং সীল সংরক্ষণের নিয়মাবলী করঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং করতে হবে।
- মিটারের রিডিং মিনিটর এবং ক্রস চেকিং করতে হবে এবং কোনো সংগতি পেলে তা বিদ্যুৎ বিলের সাথে সমন্বয় করতে হবে।
- বিলিং ব্যবস্থার উন্নয়ন অথবা ডিজিটাল স্মার্ট অনলাইন সিস্টেম করে তা কম্পিউটার নেটওইয়ার্কে যুক্ত করতে হবে।
- নিয়মিত বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় করতে হবে।
- অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ধরা পড়লেই তা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং অভিযুক্ত ব্যাক্তিবর্গকে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে।
- বিদ্যুৎ বিতরণে স্মার্ট ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
- এলাকাভিত্তিক অথবা ফিডার ভিত্তিক HT এবং LT মিটারিং করতে হবে এবং তা নিয়মিত পর্যবেক্ষন এবং বিশ্লেষণ করতে হবে।
- অসৎ কর্মকর্তা অথবা কর্মচারীকে কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
- অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার রোধে এলাকায় মাইকিং করতে হবে এবং উঠান বৈঠক পরিচালনা করতে গ্রাহক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে ইত্যাদি।
আরো পড়ুনঃ পল্লী বিদ্যুতের মিটার স্থানান্তর করার নিয়ম : বিস্তারিত
উপরোক্ত আলোচনাটি আশা করি আপনাদের অনেক উপকারে আসবে। বিদ্যুৎ সম্পর্কে বিস্তারিত আরো কিছু জানতে নিয়মিত ফলো করুন আমাদের Bidyutseva.com ওয়েবসাইট , ইউটিউব চ্যানেল
ELECTRICTY CRISIS এবং ফেসবুক পেইজ Electricity Crisis
2 thoughts on “কীভাবে বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমানো যায়?”